হিন্দু ধর্মের বর্ণপ্রথা বনাম ইসলামের মাযহাব

 


হিন্দু ধর্মের বর্ণপ্রথা বনাম ইসলামের মাযহাব

লেখকঃ মাওলানা মারজান আহমদ চৌধুরী 


গতদিন এক তরুণ বক্তার একটি ভিডিও ক্লিপ দেখলাম ইচ্ছা করেই তার নাম গোপন রাখছি তিনি বলেছেন, “হিন্দুদের মধ্যে ৪টি ভেদাভেদ আছে, ইসলামের মধ্যেও সেরকম ৪টি ভেদাভেদ আছেহানাফি, মালিকি, শাফিয়ী, হাম্বলিবক্তৃতা শুনে মনে হচ্ছিল- কিসের মধ্যে কি, পান্তাভাতে ঘি!

হিন্দুদের ভেদাভেদ বলতে বক্তা যা বুঝাতে চেয়েছেন, সেটি Caste System, অর্থাৎ জাত বা বর্ণপ্রথা বর্ণ হচ্ছে জন্মসূত্রে প্রাপ্ত একটি পরিচয়, যা স্থায়ীভাবে একজন হিন্দুর ধর্মীয়-সামাজিক অবস্থান নির্ণয় করে দেয় ঋগ্বেদ মনুস্মৃতি অনুযায়ী, হিন্দু ধর্মে ৪টি বর্ণ রয়েছেব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র ব্রাহ্মণকে সৃষ্টি করা হয়েছে ব্রহ্মা তথা ইশ্বরের মুখ থেকে, ক্ষত্রিয়কে বহ্মার হাত থেকে, বৈশ্যকে বহ্মার উরু থেকে এবং শূদ্রকে বহ্মার পা থেকে ব্রাহ্মণের কাজ ধর্মীয় বিধিবিধান পালন করা এবং শিক্ষা দেয়া, ক্ষত্রিয়ের কাজ রাজ্য শাসন এবং যুদ্ধ করা, বৈশ্যের কাজ ব্যবসা, কৃষি পশুপালন এবং শূদ্রের কাজ শারীরিক শ্রম দেয়া ৪টির বাইরে আরেকটি বর্ণ রয়েছে, যাদেরকে বলা হয় দলিত বা হরিজন দলিতকে ব্রহ্মার দেহ থেকে সৃষ্টি করা হয়নি তাই তারা অচ্ছুৎ বা অস্পৃশ্য (Untouchable), অর্থাৎ তাদেরকে স্পর্শ করা যায় না তাদের কাজ হচ্ছে বাকিদের মলমূত্র পরিষ্কার করা প্রধান ৪টি জাত থেকে আরও হাজার জাত এবং ২৫ হাজার উপজাত বেরিয়েছে হিন্দু ধর্ম এবং হিন্দুত্ব এই জাত বা বর্ণপ্রথার ওপর ভিত্তি করেই চলে

এতটুকু পড়ার পর একজন সাধারণ মুসলমানেরও বুঝতে সমস্যা হবে না যে, এসব বিশ্বাস বা প্রথার সাথে ইসলামের দূরদুরান্ত পর্যন্ত কোনো সম্পর্ক নেই কুরআন-সুন্নাহ তো বহুদুরের কথা; মুসলমানদের রচিত কেচ্ছাকাহিনীতেও ধরণের বিশ্বাসের নামগন্ধ পাওয়া যাবে না

প্রথমত, মানুষকে আল্লাহর 'অংশ' থেকে সৃষ্টি করা হয়নি আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তা'আলা ধরণের শিরক থেকে সম্পূর্ণ পাক দ্বিতীয়ত, ইসলামে কারও জন্মের সাথে তার দ্বীনি কিংবা দুনিয়াবি অবস্থান নির্ণীত হয় না আল্লাহ মানুষকে এক পিতা-মাতা থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং বিভিন্ন জাতি (Race) গোত্রে (Tribe) ভাগ করেছেন, যেন মানুষ একে অপরের পরিচয় করতে পারে পৃথিবীর সব মানুষের গায়ের রঙ, শরীরের গড়ন, মুখের বুলি, পরনের পোশাক, খাবার রুচি যদি সমান (Identical) হয়ে যেত, তাহলে পরস্পরের পরিচয় করা সম্ভব হত না বৈচিত্রের কারণেই আল্লাহর সৃষ্টি এত সুন্দর, এত আকর্ষণীয় আল্লাহ বলেছেনঃ

يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ

হে মানবজাতি, আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ নারী থেকে এবং ভাগ করেছি বিভিন্ন জাতি গোত্রে, যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে অধিক সম্মানি সে, যে অধিক তাকওয়াবান” [সুরা হুজুরাত : ১৩] 

তৃতীয়ত, জাতি গোত্রের ভিন্নতা সম্মানের মাপকাঠি নয় বরং আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন, সম্মান কেবল পরহেজগারদের জাহিলি যুগে রঙ, গোত্র, এলাকা ইত্যাদি নিয়ে এক ধরণের কৌলীন্য ছিল বলে বিদায় হজের খুতবায় রাসূলুল্লাহ সেটি পরিষ্কার করে দিয়েছেন বলেছেনঃ

يا أيُّها الناسُ إنَّ ربَّكمْ واحِدٌ وإن أباكم واحد أَلَا لَا فَضْلَ لِعَرَبِيٍّ عَلَى أَعْجَمِيٍّ وَلَا لِعَجَمِيٍّ عَلَى عَرَبِيٍّ وَلَا لِأَحْمَرَ عَلَى أَسْوَدَ وَلَا أَسْوَدَ عَلَى أَحْمَرَ إِلَّا بِالتَّقْوَى النَّاسُ من آدمُ وآدمُ من ترابٍ

হে মানবজাতি, তোমাদের রব এক এবং তোমাদের পিতাও এক জেনে রাখ, কোনো আরবি ব্যক্তির মর্যাদা নেই অনারব ব্যক্তির ওপর কোনো অনারব ব্যক্তির মর্যাদা নেই আরবি ব্যক্তির ওপর লালটে (ফর্সা) ব্যক্তির মর্যাদা নেই কালো ব্যক্তির ওপর কালো ব্যক্তির মর্যাদা নেই লালটে ব্যক্তির ওপরকেবল তাকওয়া ব্যতীত (জেনে রাখ) সমস্ত মানুষ আদম থেকে এবং আদম মাটি থেকে” [শাব্দিক ভিন্নতার সাথে মুসনাদে আহমাদ, শুয়াবুল ঈমান, শারহুত তাহাবী] 

উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম বাইহাকী 'শুয়াবুল ঈমান' কিতাবে লিখেছেনঃ

فقال يا أيُّها النَّاسُ إنَّ ربَّكم واحِدٌ، قدَّم النَّبيُّ صلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ بهذا الكَلامِ لتَذْكيرِ الصَّحابَةِ باللهِ عزَّ وجلَّ، كما أنَّه أرادَ أنْ يَنفيَ فَضْلَ البَعْضِ على البَعْضِ بالحَسَبِ والنَّسَبِ كما كان في زَمَنِ الجاهِليَّةِ؛ لأنَّه إذا كان الرَّبُّ واحدًا لم يَبْقَ لدَعْوى الفَضْلِ بغَيرِ التَّقْوى مُوجِبٌ، ثم قال ألَا لا فَضْلَ لعَرَبيٍّ... أي لا فَضْلَ لأحَدٍ على أحَدٍ على الإطْلاقِ إلَّا بتَقْوى اللهِ عزَّ وجلَّ وهذه دَعوَةٌ للنَّاسِ حتى يَترُكوا الفَخرَ بالحَسَبِ والنَّسَبِ وأنْ يَجْتَهِدوا في عِبادَةِ اللهِ عزَّ وجلَّ

রাসূলুল্লাহ সাহাবিদেরকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যেতোমাদের রব একবাক্য দিয়ে কথা শুরু করেছেন তিনি ইচ্ছা করেছিলেন, বংশ গোত্রের দ্বারা একে অন্যের ওপর মর্যাদা লাভের বিষয়টিকে নাকচ করে দেবেন, যেটি জাহিলি যুগের প্রথা ছিল কেননা সবার রব যদি এক হন, তাহলে রবের তাকওয়া অর্জন করা ব্যতীত অন্য কোনোভাবে মর্যাদা লাভের বিষয়টি অবশিষ্ট থাকে না অতঃপর তিনি বলেছেন, কোনো আরবি ব্যক্তির মর্যাদা নেই... অর্থাৎ আল্লাহর তাকওয়া অর্জন করা ব্যতীত সর্বতোভাবে একজনের ওপর অন্যজনের কোনো মর্যাদা নেই এটি ছিল মানবজাতির প্রতি রাসূলুল্লাহ এর আহ্বান, যেন তারা বংশীয় এবং গোত্রীয় অহংকার পরিত্যাগ করে আল্লাহর ইবাদতে রত হয়

এই হচ্ছে হিন্দু ধর্মের জাত বা বর্ণপ্রথার সাথে ইসলামের পার্থক্য এবার আসি মাযহাবের পরিচয়ে রাসূলুল্লাহ যতদিন পৃথিবীপৃষ্ঠে ছিলেন, ততদিন পর্যন্ত সাহাবিরা তাঁকে দেখে, জিজ্ঞেস করে দ্বীন পালন করেছেন কখনো কোনো সাহাবি ইজতিহাদ (গবেষণা) করেছেন সঠিক হলে রাসূলুল্লাহ কবুল করেছেন, ভুল হলে ঠিক করে দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ ইহজগত থেকে বিদায় নেয়ার পর সে সুযোগ বন্ধ হয়ে গেল যেহেতু নুবুয়্যাত ওহীর দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে, সুতরাং 'প্রশ্নাতীত কর্তৃত্ব' (Unquestionable Authority) বলে আর কেউ বাকি থাকলেন না এরপর নতুন কোনো প্রশ্ন (মাসয়ালা) সামনে আসলে সাহাবিরা কুরআন-সুন্নাহ থেকে এর সমাধান খুঁজার চেষ্টা করতেন না পেলে নিজেরা ইজতিহাদ করতেন স্বাভাবিকভাবেই একজনের ইজতিহাদ অন্যজনের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন হতো যেহেতু ওহীর দরজা বন্ধ, তাই কারও ইজতিহাদের ওপর আল্লাহ তাঁর রাসূলের 'মোহর' লাগানোর সুযোগ ছিল না ধীরে ধীরে সাহাবিরা নতুন বিজিত এলাকাগুলোতে ছড়িয়ে পড়লেন দ্বীন শিক্ষা দেয়ার জন্য তাঁদের ইজতিহাদ উপলব্ধি তাঁদের ছাত্রদের কাছে হস্তান্তরিত এবং আরও সম্প্রসারিত হলো নতুন যুগ, নতুন জিজ্ঞাসা, নতুন ইজতিহাদ, নতুন সমাধানতাই পরবর্তীদের মধ্যেও গবেষণাগত মতভিন্নতা তৈরি হলো

অনেকে বুঝতে পারেন না যে, মুজতাহিদদের মধ্যে মতভিন্নতা কেন তৈরি হয় একটি ছোট উদাহরণ দেই ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স করেছেন এমন দশজন ব্যক্তিকে আমি আমার লেখাটি দিলাম ইংরেজি অনুবাদ করার জন্য আপনি কি মনে করেন সবার অনুবাদ হুবহু এক রকম হবে? মনে হয় না কেউ করবেন শাব্দিক অনুবাদ, কেউ ব্যাখ্যামূলক, কেউ ভাবার্থ, কেউ সরল, আবার কেউ করবেন শেক্সপিয়রের ভাষায় একই ব্যাপার ঘটে, যখন কয়েকজন মুজতাহিদ ইজতিহাদ করেন যদিও তাঁরা যোগ্য এবং তাঁদের মূলনীতি অভিন্ন, তবুও চিন্তা উপলব্ধির ভিন্নতার কারণে ফলাফল ভিন্ন ভিন্ন হয় মতভিন্নতা কেবল ফকীহদের মধ্যেই নয়; বরং মুহাদ্দিসদের মধ্যেও হয় একজন একটি হাদীসকে সহীহ বলেছেন, আরেকজন বলেছেন দ্বয়িফ ইমাম বুখারী ইমাম মুসলিমের কাছে হাদীস 'সহীহ' হওয়ার মাপকাঠি হুবহু এক রকম নয়

মুজতাহিদদের মধ্যে মতভিন্নতা কীভাবে তৈরি হয় সেটিও বুঝা প্রয়োজন সমস্ত ইমাম-আইম্মা একমত যে, ইসলামী শরীআতের প্রাথমিক উসূল বা মূলনীতি ৪টিকুরআন, হাদীস, ইজমা (ঐক্যমত) এবং সবশেষে কিয়াস বা ইজতিহাদ কিন্তু কুরআন-হাদীস থেকে কীভাবে দলিল গ্রহণ করা হবে, সেই কায়িদা বা পদ্ধতি (System) ভিন্নজনের কাছে ভিন্ন রকম এই পদ্ধতিগত ভিন্নতাকে বলা হয় 'মাযহাব' (Schools of Thought) মাযহাব আল্লাহর প্রেরিত শরীআহ নয়; বরং শরীআহকে বুঝার পদ্ধতি এক সময় আহলে সুন্নাতের মধ্যে ২২টি মাযহাব ছিল পরে সেগুলো একটি অপরটির ভেতর আত্তীকরণ (Assimilation) হয়ে ৪টি মাযহাব বাকি থেকেছেহানাফি, মালিকি, শাফিয়ী হাম্বলি আল্লাহর হুকুম-আহকাম এবং রাসূলুল্লাহ সব সুন্নাহ এই ৪টি মাযহাবের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে গেছে এদের মধ্যে আকীদা এবং উসূলের ব্যাপারে কোনো পার্থক্য নেই, মৌলিক ইবাদতের ক্ষেত্রেও দ্বিমত নেই ভিন্নতা শুধু উসূল বা মূলনীতি থেকে দলিল গ্রহণ করার পদ্ধতি সম্পর্কে ৪টি মাযহাব এজন্য গ্রহণযোগ্য যে, উম্মাতে মুহাম্মাদীর সুবিশাল অংশ (সাওয়াদে 'যম) ৪টি মাযহাবের ওপর সম্মত হয়ে গেছেন রাসূলুল্লাহ বলেছেনঃ

إِنَّ أُمَّتِي لَنْ تَجْتَمِعَ عَلَى ضَلاَلَةٍ فَإِذَا رَأَيْتُمُ اخْتِلاَفًا فَعَلَيْكُمْ بِالسَّوَادِ الأَعْظَمِ

আমার উম্মাত কখনও ভ্রান্ততার ওপর একমত হবে না অতএব যখন মতপার্থক্য দেখতে পাবে, তখন তোমাদের উচিৎ (উম্মাতের সুবিশাল অংশ) সাওয়াদে 'যম-এর অনুসরণ করা” [সুনান ইবন মাজাহ; কিতাবুল ফিতান]

অথচ কোনো কিছু না জেনেই আমাদের তরুণ বক্তা হিন্দু ধর্মের বর্ণপ্রথার সাথে ইসলামের মাযহাবকে মিলিয়ে ফেললেন! সম্ভবত কম বয়সের খ্যাতি তার বোধশক্তি কমিয়ে দিয়েছে নইলে তিনি বুঝতে পারতেন যে, হিন্দু ধর্মে উঁচুরা নিচুদের গায়ে স্পর্শ করলে জাত চলে যায় আর ইসলামে উঁচুনিচুর ভেদাভেদ ভুলে কাঁধের সাথে কাঁধ মিলিয়ে না দাঁড়ালে নামাজই পরিপূর্ণ হয় না


Post a Comment

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

Previous Post Next Post

Featured post